পড়তে পড়তে কিছু দৃশ্য | বেলায়েত মাছুম


পড়তে পড়তে কিছু দৃশ্য | বেলায়েত মাছুম | বাংলা গদ্য।


 ক.

একটা পাখি বাড়ির উপর উড়ছে। এমন দৃশ্য প্রতিদিনই আমি দেখি। উড়তে উড়তে পাখিটা উপরে উঠে যায়, নিচে নেমে আসে। পাখি উড়তেই থাকে আর আমি দেখতে থাকি। দেখতে দেখতে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, সেই পাখি আস্তে আস্তে কোথাও চলে যায়। আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকি। ঘুম কত গভীর হলে মানুষ অন্য জগতে চলে যায়? সেখানে হাটতে থাকে, দৌড়াতে থাকে? যেন এমন ভাবতে ভাবতে আমি হাটতে থাকি পরিচিত এক রাস্তা দিয়ে, মানুষের পায়ে হাটা রাস্তা বিশাল বড় মাঠের মধ্য দিয়ে,  আমি হাটতে হাটতে দৌড়াতে থাকি আর হঠাৎ করে রাস্তাটা শেষ হয়ে যায় আর আমি ফুটা বেলুনের মতো পড়তে থাকি।

আমি পড়তে থাকি পৃথিবীর দিকে। যেন এই পৃথিবীই আমাকে ডাকছে, দ্রুত নামতে নামতে দেখতে পাই একটা ছেলে বাড়ির সিড়ি ঘরের ছাদে বসে আছে। তার বয়স অনুমান করা যায় কিন্তু আমি ভাবতে পারছিনা। দ্রুত, কোথাও পড়তে পড়তে আমি থেমে যাই অথবা থামানো হয়। এসবে আমার কিছু যায় আসেনা, ছেলেটাকে দেখতে থাকি, তার হাতে একটা আইসক্রিম, লাল টুকটুক। কোথা থেকে সে এটা পেল আমার জানা না থাকলে হবে কিন্তু মনে হয় আমি জানতে চাই। দেখতে থাকি- একটা লোক বাড়ির উঠানে বসে আছে।

টাকওয়ালা এক আইসক্রিম বিক্রেতা বাড়ির উঠানে বসে আছে। দুই জন ছেলে তার সামনে বসা, তারা হয়তো দরদাম করছে। একজন একটা লাল আইসক্রিম নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠে এলো, এদিক ওদিক থাকিয়ে সিড়ি ঘরের ছাদে উঠে বসলো আর পা দুলিয়ে লাল আইসক্রিমটা চাটতে লাগলো। পড়তে পড়তে আমি ভাবতে থাকি দৃশ্যটা আরো দীর্ঘ করা দরকার, হাতে অনেক সময়। আবার প্রথম থেকে দেখা যাক।

আমি পড়ছি, একটা ছেলে লাল আইসক্রিম নিয়ে বাড়ির সিড়ি ঘরের ছাদে বসে আছে। আরেক জন টাকওয়ালা আইসক্রিম বিক্রেতার সামনে বসা, সেও একটা লাল আইসক্রিম নিয়ে ছাদে ফিরে এলো। দৃশ্যটা এখানেই শেষ, কিন্তু আমার হাতে অনেক সময়। দৃশ্যটা আরো দীর্ঘ হলে ভাল হয়। আমি পড়ছি আর ভাবছি, ভাবছি আর দেখছি। 

বড় ছেলেটা লাল আইসক্রিম নিয়ে ছাদে ফিরে এলো। সে সিড়ি ঘরেরে ছাদে উঠার জন্য একটা বেতের পিড়ি টেনে আনলো এবং পলকেই পা টাঙিয়ে বসে পড়লো। আমি আনন্দ নিয়ে দেখছি, ছোট ছেলেটাও আইসক্রিম নিয়ে এলো ছাদে, সেও বসতে চায় পা দুলিয়ে কিন্তু বড় ছেলেটা তারে উঠতে দিলো না, পিড়িতেই বসে পড়লো। এমন সময় আমার চোখে পড়লে দু'টি মেয়ে চুল টানাটানি করছে।

খ.

এক দরজার বাইরে একটা বিড়াল ডাকছে। ঠিক ডাকছে বললে হয়তো ভুল হবে। হয়তো কাঁদছে? কেন? তা আমি বুঝতে পারি না। আমার বুঝার দরকার নাই, কিন্তু বুঝতে পারলে হয়তো ভাল হতো। হয়তো আমি তার জন্য কিছু একটা নিয়ে আসতে পারতাম, আমারতো ডানা আছে, উড়তে উড়তে বাজারে চলে যাই। দোকান থেকে চকলেট কিনবো ভাবি কিন্তু ফিরে এলাম দু'টি লাল আইসক্রিম নিয়ে। বিড়াল কি আইসক্রিম খায়? এমন চিন্তা করতে করতে আমি পড়তে থাকি। পড়তে থাকি পৃথিবীর দিকে।

পৃথিবীতে আমার কে থাকে?

পড়ছি আর দেখছি। মেয়ে দু'টি চুল টানাটানি করছে। তাদের বয়স কত হবে? কোন মেয়ে বড় আর কোন মেয়ে ছোট? এসব দিয়ে আমার কী হবে? এমন চিন্তার ফাঁকে দেখি আরো একজন দাড়িয়ে আছ। সেও মেয়ে, আগের দু'জনের চেয়ে বড়। মনে হচ্ছে মাত্র গোছল থেকে ফিরেছে। বাতাসে চুল শুকাতে শুকাতে হাওড়ের দিকে চেয়ে আছে। এখন কোন মাস? এমন মনোরম হাওয়া বয়ে যাচ্ছে যে কোন মাস চলে তা না জানলেও হবে।

এখন হয়তো চৈত্র? হয়তো কার্তিক? হয়তো। আমার কোন মাস প্রিয় ছিল? আষাঢ় না পৌষ? ভুলে গেছি। পাখি হয়ে গেলে আর মনে রাখার প্রয়োজন থাকে না। যে মাসই হোক আমার ভাল লাগছে এমন হাওয়া ভেঙে পৃথিবীর দিকে নামতে।

গ.

বড় মেয়েটা চুল শুকাতে শুকাতে কার কথা ভাবছে? এমন প্রশ্ন আমার মনে জাগছে। আর এমন উদাস হয়ে কেনই বা তাকিয়ে আছে বুঝতে পারছি না। মানুষ কেন যে কেবল মানুষের কথাই ভাবে, কেন যে তারা ভাবতে ভাবতে উদাস হয়ে যায়, এমন ভাবতে ভাবতে দেখি আমি পুথিবীর কাছাকাছি চলে এসেছি।

আমি কেন পাখি হয়ে গেলাম? কিংবা পাখি আমার মতো হয়ে গেল কেন? এমন প্রশ্ন আমি কার কাছে করব? আর যদি পাখি হয়েই গেলাম তবে কেন মাটির দিকেই পড়ছি? ছেলে দু'টির আইসক্রিম প্রায় শেষ, চুলাচুলি করা মেয়ে দু'টি কি যেন করছে, দেখতে পারছি না। যতই পৃথিবীর কাছে চলে আসছি চোখ দু'টো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। উপরের দিকে উঠতে চেষ্টা করেও পারছি না, হঠাৎ খেয়াল হলো আমার ডানা নাই। উধাও হয়ে গেছে, ওগুলো কী তবে মোমের তৈরি ছিল?

পৃথিবীর দিকে দ্রুত পড়ছি। পাখিরতো ডানা থাকে, এমন স্মৃতি কথা অন্য পাখিরা আমায় বলে ছিল। যখন তারা পৃথিবীতে ছিল না, যখন তারা পৃথিবীর বাহিরে ছিল, একেক জোড়া ডানা নিয়ে তারা উড়তে পারতো।

পৃথিবীর বাহিরে পাখিরা কেমন থাকে?


ওল্ডহাম/২০২২