কিছু দৃশ্য তবু ভাবা যায় | বেলায়েত মাছুম

চিত্র: Wassily Kandinsky - Untitled



একটা সিনেমার কথা ভাবছি। যা এখনো কেউ বানায় নি, কিংবা কেউ হয়তো অনেক আগেই বানিয়ে মরে গেছে, আমি ঠিক জানি না। আমার জানাশুনা কম। শুধু জেনেছি দেয়ালের কান আছে, তবুও দেয়ালের শরীরে গা এলিয়ে অনেক কথা ফিসফিস করে বলা হলেও তা আমি নিজেও শুনতে পাইনি। আমার রোগ হয়, আমি সিনেমার কথা ভাবি। একটা বৃদ্ধ লোক, যে গ্রামে বেড়ে উঠে। শহরেও হতে পারে। আমি শেষবার যখন লোকটারে দেখি, কল্পনায়। হাটছিল,খুড়িয়ে খুড়িয়ে। জানিনা তার পা আছে কি নেই, কোনদিন পায়ের দিকে তাকাই নি। কোন পা দিয়ে সে হাটে আমার দৃশ্যে নেই। আমার গলা শুকিয়ে যায়, লবণ পানি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করি, এ ধুমপানের ফল। যদিও অনেক বছর যাবৎ আমি আর এসবে নেই। শেষবার যখন আমার নাকে ধূয়ার গন্ধ পাই, তা ছিল ভিষন ঠান্ডা। কুয়াশার জাল কেটে কেটে বৃদ্ধ লোকটা হেটে যায়, আমি দেখতে পাই পিছন হতে। উপর থেকেও হতে পারে, ঠিক নাই। ইচ্ছে হয় লোকটারে ডাকি, আবার ভয়ও হয় যদি সে হাটতে হাটতে ঘুমিয়ে থাকে আর আমি জাগিয়ে তুলি, ভাল হয় না। তাই দেখতে থাকি। লোকটা হাটে, গ্রামের পথে। সবুজ জংলী পথ শহরেও থাকতে পারে, জানা নেই, যদিও বহুকাল ধরে শহরে ঘুরি।

 মনে হয় এটা শীতকাল। আমি কোন রোগে আক্রান্ত ডাক্তার হয়তো বলতে পারবেন। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে সিনেমায় ডুবে যাই। বৃদ্ধ লোকটা হয়তো কোনদিন যুবক ছিল, হয়তো না। আমি আগেই বলেছি আমার জানাশুনা কম। তবুও কল্পনায় দেখি যুবক লোকটা ডুব দেয় পুকুরের জলে। ডোবা পুকুর। খসে পড়ে গেছে চারপাশের পাড়। একদিন এই পুকুরে হয়তো লবণ চাষ হতো, সে আদিকালের কথা। প্রপিতামহ কিংবা সেই সময়ের কারো সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই, কোনদিন কোন গল্প বলার ছলে তারা আমার কাছে আসেন না। আমি দেখতে থাকি বৃদ্ধ লোকটা ডুবে যায়, আসলে দৃশ্যটা তার যুবা কালের।

বিকেল বেলা হাটতে বেড় হই।  মাঠে যাই, সবুজ ঘাসের শরীরে শরীর রেখে হামাগুড়ি খেলি। এই সব যৌবনের কথা। হাটতে হাটতে মুখস্থ বিদ্যা উজাড় করতে থাকি। সিনেমার ভেতর পান করি মসলা পান। পিক দানী থেকে চোখ ফেরাতেই দেখি লোকটারে। লুঙ্গি পড়া অকাল বৃদ্ধ মানুষটারে। হেটে যায়, পুকুর পাড় দিয়ে। প্রত্যেক বিকালে লোকটা এভাবে হেটে যায় কি না, জানি না। আমার প্রতিদিন খেলার অভ্যাস নাই কিংবা শারীরিক কসরতে আমি হেরে যাই, এসব আমার ডাক্তার ভাল জানেন, যদিও বন্ধুদের কাছে ভাব ধরে থাকি, এ তল্লাটে আমার মতো আর কেউ নেই।

এই লোকটা যে সিনেমার অভিনেতা, জানা ছিলনা। আমার চোখে যে ছানি পড়া রোগ লোকটাও জানেনা। দেখতে থাকি, লোকটা বসে পড়ে এবং তাস খেলায় মঁজে যায়। তার বন্ধুদের সাথে গল্পের ছলে কার কথা বলে শুনতে পাই না, হয়তো বাড়িতে রেখে আসা বউ কিংবা বউদের কথা।

আমার শৈশবে একটা কুকুর ছিল, লাল রঙের। লালু নামে ডাকতাম। লোকটারও হয়তো শৈশব ছিল, লালু বা কালু নামের কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়াতো সকল পাড়ায়। সকালে বিকালে হাজিরা দিত মৌলভীর ঘরে। এসব অনেক আগের কথা, এখন বয়স বেড়ে গেছে। সপ্তাহে দুবার চুলে,  দাড়িতে কলুপ দেয়া হয়। আয়নায় দেখে লোকটা হেসে উঠে। কল্পানায় দেখতে পায় এক কৃষ্ণচূড়া গাছ। চারদিক একা করে বসে আছে মাঠের ভেতর। যদিও আমি এসব কল্পনায় দেখি, আসলে ওটা একটা শূন্য ঘরের চেয়ার। যার পাদানি আছে অথচ একটা পা নেই।


বৃদ্ধ লোকটা জলের কাছে দাড়ায়। নৌকায় উঠার ভান করে। যে নৌকা প্রতি শুক্রবার বাজারে যায়। এই হাট বারে যারা হাটে তাদের দেখা হয়। মোরগ এবং গরু সহ আরো গৃহপালিতরা সমবেত হয়, তারা আবারো পালিত হবে এমন সংবাদ হাটের হাওয়া রাখেনা। লোকটা বাজারে হাটতে থাকে। মানুষের সাথে দেখা হবে বলে কোন মানুষের সাথে দেখা হয়, জানিনা।