মনে হয় আমি হাওয়া হয়ে যাই | বেলায়েত মাছুম



১.
মনে হয় আমি হাওয়া হয়ে যাই। আব্বার কবরের পাশে অচেনা এক লোকের মতো বসে থাকি। ধীরে- দূর পাহাড় থেকে ভেসে ঘোরা মেঘের সাথে চলতে থাকি। ঘাসের সাথে পাতার সাথে শুয়ে নিদ্রা যাই। মনে হয় আমি দূরের বনের ভিতর হাওয়া হয়ে উড়ি। আমার কোন বাড়ি থাকবেনা তবু পৃথিবীর সকল দরজা চেয়ে রবে আমারে দিকে।

ফুলের পাঁপর ঝরে যাবে আর সন্ধ্যার আলো মেখে আমি ফিরবো ঘরে। আঙিনায় পড়ন্ত পাতার সাথে উড়ে উড়ে চলে যাবো সেই পাখির বাসায়। যে আমার থেকে দূর, দূর থেকে বসে অপলক নিদ্রা যাবে বলে জোনাকী পুষতে থাকে।

অন্ধকারের ভেতর হতে কয়েকটি হাত, আরো কিছু পা আমার শরীর মাড়িয়ে চলে যাবে পড়ন্ত পাতার দিকে। হাওয়ার স্পর্শে পাতা আহলাদি হয়, আমার দরজা, উঠোন পেরিয়ে বনের পরে আব্বার কবরের দিকে চলে যায়। আমি অন্ধ হতে থাকি আর বন্ধ চোখের ভেতরে ঝলসানো আলোয় মঁজতে রই। আর কোন চোখ নেই আমার রাতের পাখির মতো গন্ধ শুকে পাতার ভাঁজে যেন নিজেরে লুকাই। 

আনন্দ নিয়ে কোথায় যায় লোক? মেঘের কোলে কত আরতি জমে! তবু, জাহাজের নাবিকের মতো চেয়ে থাকি আমি; জলের গভীরে মাছের সংসার দেখি— অবিরাম স্রোতে উজ্জ্বল চোখগুলো নিয়ত যেন আমার দিকেই থাকায়। আমি আর কোথায় যাবো? উড়তে উড়তে সন্ধ্যা ফুরায়ে যায়।

আব্বার কবর হতে কত দূর আমি? কত সমুদ্রজল মেখে নাবিক, লবণ চাষী আর মাছ ধরা লোক ফিরে আসে তার ঘরে— তবু কিছু আলো সন্ধ্যার পাশে দাড়ায়। রাতের প্রতি অধীর প্রার্থনা নিয়ে সংসারী লোকের মুখোমুখি বসে।

ভাবি আমি হাওয়া হয়ে যাবো। চিরদিন ঘাসের সাথে- পাতার সাথে সখ্যতা হবে। জলের উপর দিয়ে ধীরে হেটে পাড় হবো সমস্ত বর্ষার বিকেল। আমি যার ছায়া নিয়ে ঘুরি, তার কোলাহল যেন তলিয়ে যায় সেই সনাতন সমুদ্র নীলে। ভাবি আমি হাওয়া হয়ে যাবো— সন্ধ্যার ছায়া হয়ে আব্বার কবরের পাশে আমার মতো কোন এক লোকের শরীর নিয়ে হেটে যাবো।

২১/০১/২০২০

২.
সন্ধ্যায় না ফেরা হাঁসেরও আছে ডানা—  এমন কথা যদি আম্মারে বলি— হাসতে হাসতে হয়তো তিনি চলে যাবেন আব্বার দিকে। হাঁস-ঘরের দরজা খুলে তারা দু'জনে গুনতে থাকবেন কয়টা হাঁস আজ ফেরারী হলো। বর্ষার ঢেউয়ে ভেসে থাকা হাঁস জোছনার কথা হয়তো জানে, হয়তো স্বপ্নের ঘোরে দ্বীধায় পূর্ণ হৃদয় নিয়ে কোথাও আগুন্তুক হয়।

আমি হাঁসের কথা আম্মারে তবু বলি, পাড় থেকে কিছু হাঁস উড়তে উড়তে পুকুড়ের জলে নামতে থাকে। আর আম্মায় আমারে কিছু বলতে থাকেন— আমি যেন বধির লোক— কিছু আর শুনতে পাইনা। আম্মা হাটতে থাকেন আর হাসগুলো আমায় দেখে মুচকি হাসে।

ঝড়ের সন্ধ্যায় আম্মার হাঁসগুলো কোথায় যায়?

আমার কোন ডানা নাই, তবু মনে হয় এক ঝড় মুখর সন্ধ্যায় আমি আম্মার হাঁস হয়ে যাই। পাখির উড়ার মতো ডানার ভরে কিছুদূর উড়তে থাকি। হারিয়ে যাওয়া হাঁসের মতো একদিন ফিরে এসে আম্মার উজ্জ্বল চোখের মুখোমুখি হই। 

১২/০২/২০২০

৩.
কত সন্ধ্যায় ফেরারী হবো ভেবে বাড়ি ফিরে এলাম। আলনায় রাখা বাসি কাপড়ের গন্ধ নিয়ে আমি ঘুমাতে যাই। আমার চোখের পাতায় যেন আঁকা আছে এক পথের ছবি, হাটতে হাটতে যখন হারিয়ে যাবো ভাবি— দেখি আলনার কাছে বসে আছে একজোড়া মুখ। আলোর আভা নিয়ে আমার চোখের দিকে থাকায়, সেই পুরনো গন্ধ নিয়ে ডাকতে থাকে আর ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে আমি ফেরারী হবো বলে হাটতে থাকি।

হাটার শব্দে যেন পথের ধুলো মগ্ন হয়ে যায়। হাটতে থাকি দূর থেকে দেখা সেই গাছের দিকে, যার পাতাগুলো বাতাসের কাছে একজোড়া ডানার জন্য প্রার্থনা করে। আমি সেই গাছের ছায়ায় দাড়াই আর ডানাহীন পাতার কাছে আমার পুরনো গল্প বলি।

আমার ডানা নাই তবু একদিন ফুলের কাছে উড়ে যাই!

সন্ধ্যায় আর্ আর্ ফুলের মতো ধুলোর বুকে ঘুমিয়ে থাকি। হাওয়ার চলাচল যেদিক থামে— মনে হয় উৎসব শেষ। আমার চৌদিক নিয়ে যেন হাওয়া পলাতক হয়। তবু আমি ফেরারী হবো ভেবে ক্লান্ত চোখ দুটো নিয়ে হাটতে থাকি— কোথায় আর যাবো? সময়ের গন্ধ মাখা দেয়ালে নাক ডুবিয়ে ঘুরতে রই।


২৩/০৬/২০২০