আমাদের দীর্ঘ সাক্ষাতকার বিষয়ে বই থেকে দশ কবিতা | বেলায়েত মাছুম




নৈশ সভা


নৈশ সভায় কোন গল্প হয় না
পরস্পরের খোঁজ-খবর কিংবা পাখির কথা;
নিশিতে যে ডেকে উঠে জানালার পাশে
ঘাস কাটা যন্ত্রের শব্দ নিয়ে-
তার কথা কোন দিন আমরা বলবনা।

সভার টেবিলে আঁকা ড্রাগন ট্যাটু
সূর্যের লালা নিয়ে নিবিষ্ট প্রার্থনায়;
সভা ঘরে জানালা ছিল না এবং কোন শব্দ।

রাত নেমে এলে বসে থাকি
শৈশব নিয়ে;
বারুদের গন্ধে
পিপাসা ও ক্ষুধায় মজে শুয়ে থাকি
সভা শেষে- ত্রাণের আশায়।



একদিন

একদিন তারে ভালবেসে ফেলি- কতদিন গেল
কতদিন তারে নাম ধরে ডাকি, গোপন যত ফুলের নামে;
পাখির ঠোঁটের কাছে যত কথা হয়, যত আবৃত শামুক শরীর
হেটে যায় বুকের আলপথ দিয়ে- 
সে খবর কেউ রাখেনি, আমিও না জানি।
আমার গোধূলীতে বসে সে গেয়ে যায়
অনন্ত পথের ধুলোর মিছেলে কেবল হেটে যায়
এইখানে একদিন যে সুরে বেহুলা কাঁদে- লখিন্দর কাঁদে
গৌড় রাজার প্রাক্তন স্ত্রীর চুলের সিঁথি রেখা ধরে-
মনে হয়ে তারে নাম ধরি ডাকি- একদিন নদীর দিকে
হাওয়ার সুরে ভুলে যাই নগরী আলোর কোলাহল নিনাদ।



মাছ সম্পর্কে

ধরা যাক মাছগুলো ঘুমোয়নি কিংবা জলের
ভিতরে অথৈ শীত, নখগুলো ভিঁজে কাতর
গরম কাঁথার নিচে উষ্ণ গভীর তল।

ধরো গাই মাছেদের গান, জলের অসীমে বাঁধি এক ঘর
সারা শরীর নোনা স্বাদে ভরা আর চেয়ে আছে জলজ ভবিষ্যৎ।

ঢেউগুলো ইথার শব্দের মতো গায় ভ্রমণের গীত
আর মাছেরা ধামাইল নাচে মেতে রয়;
অলীক অসুখ হলে ছোঁয়াচে রোগের ভাবনায়
ডুবে যেতে হয়- ভেসে যেতে হয়।

ধরি মাছেরা খুঁজে আড়াল, আরো মাছেদের থেকে দূরে
আরো বেশি গভীর আরো বেশি জলের সিনার ভিতরে।




চৈত্র বিষয়ে

আমরা তেমন কিছু আর বলছিনা চৈত্র বিষয়ে
গোপনে টুকানো শেষে বিকেল নেমে এলে আমাদের হয়ে
ফুলের পাপড়ি ভুলতে চায় পাখির সোহাগ;
আগত সন্ধ্যার কথা ভাবতে ভাবতে বর্ষা উড়ে এলো-
পিপড়ার চলন ধ্বনি শুনছেনা পুরনো দেয়াল।

একটা খাদক টিকটিকি সারা সন্ধ্যা আগলে রাখে
আমাদের চোখের পাতায় জড়ো হয় ঘুম
হাওয়ার ভরে ঘুরে বেড়ায় শোকার্ত দিন, শোকার্ত রাত।

কাচের আয়নায় বেঁজে উঠে ঠোঁট- ঝুনঝুন, ঝুনঝুন।

এবার আমরা সংসারী হবো, কাঠের আলনায় দোলাবো শরীর
ভীষন ইচ্ছায় লাল গোল গোল সারা রাত পর ফুলের কান্না পায়;
আবার চৈত্র এলে বৈশাখীও ফিরে আসে আমাদের ঘর।
এখন পুতুল বিয়ের দিন, চারিপাশে অকাল বর্ষা
পায়ের পাতায় আলতার ফুল; পানের বরজ আরো দীর্ঘায়ু হয়
জাহাজও ভ্রমণে আসে আমাদের শহর।




রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে

আহত পাখিরা সে রাতেই মারা গেলো
শোকবইয়ে দু'বাক্য লিখবেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি
এমন প্রতিশ্রুতির খবর জানালো আমাদের টিভিগুলো;

আমাদের জানালা ভেঙ্গে পড়লো শব্দের ভারে
আকাশে উড়তে দিলাম ঘরে পোষা পায়রার দল
সূর্যের উত্তাপে ভীষণ চিকচিকে হলো
বঙ্গ ভবনের সাদা দেয়াল।

রাষ্ট্রপতির মৃত্যু সংবাদে শোকার্ত বিদেশী দূতাবাসগুলো,
রঙিন মোড়কে ফুলের তোড়া নিয়ে এগিয়ে এলো সাঁজোয়া যান।

প্রতুশ্রুতি মোতাবেক আমরাও দাড়ালাম ম্লান মুখে
বঙ্গ ভবন হতে গাড়ির বহর ছুটে এলো
বিষন্ন হাওয়ায় পতপত উড়লো অর্ধ-নমিত পতাকা;
শুধু শোকবইয়ে রাষ্ট্রপতির স্থবির ছবির নিচে-
স্বাক্ষর দিতে উঠে দাড়ালেন না স্বয়ং রাষ্ট্রপতি।



ঘাসের অসুখ

একদিন ঘাসের শরীরে হবে জ্বর, শুন্যে নেমে যাবে শিশিরের তাপ
উত্তর মেরু ভ্রমণের ঘোরে- দক্ষিণ মেরু ভ্রমণের ঘোরে
এক পাল ঘাস ফড়িঙের দল- রোদ চশমা লাগিয়ে ঘুরে
বেড়াবে, ঘাসের ওপারে ঝাউবনের ভেতর।

অহিংসার কিছু আগুন হবে
অগুণতি রোদেল ঢেউ ছুয়ে যাবে ঘাসের ঠোঁট
ক্ষয়ে যাওয়া লবণ দানায় আটকে রবে ছুপ ছুপ জল।

এমন একদিন পলাতক হাওয়া ঘুরে বেড়াবে আমাদের শহর
ধুলোর টগবগ শিখা- তরুণ ঘাসের ঠোঁটে পোহাবে উপোস রাত।

দুধাল ঘাস অসংকোচে পুড়ে হবে ছাই, ফুলের বাগান হতে
ফুলের রেণু-পাতা ঝরার শব্দে উন্মুখ আরো কিছু ঘাস
বেহাল কর্তাল ধ্বনি, বায়ুবাহি অন্য ঘাসের ঘ্রাণ সহ
মেরু ভ্রমণ শেষে ফিরে এলে-
ঘাসের অসুখ আলপথ ধরে বহুদূর- কতদূর ভেসে যায়?



বাকি রাত

বাকি রাতটুকু কেটে যাক নার্সারি বাগানে, চোখের পাতার কাছে
এক লাশকাটা ঘরে, অধল হয়ে গেলে পুরনো রুপার চামচ
পুকুর পাড়ের ঘাসে শুয়ে পড়া যাক-
এই রাতে ফুটে উঠুক দুধেল ফুল, সোনার দেরাজ খুলে
জুতোজোড়া পায়ে- পৌছার পথ ধরে কিছু আলো নিভুক;
ভাড়াটে ঘুমের বহর পুরিয়ে এলে, নিজেও পৌছে যাই ভ্রুণের শহর।

দখিন দুয়ার খুলে এক আলতার বরজ, আর সহজিয়া সুরভী মাখা
খুনের করাত। ভুলে ভরা দেয়ালিকায় রঙ কিছু লেপে-
হারানো গানের সুরে আমরাও মাতি।

বাকি রাত শুয়ে থাকি চাষার ঘরে, ফসল কাটার দিন
গনিয়ে এলে- কিছু বীজ বপন করি নদীর ধারে
আর কিছু পাকা ফুলের কুসুম শুকিয়ে রোদে-
নিজের দোকানেই সদাই সারি;
কুহুকাল ডুবে থাকি সিঁথি রেখা ধরে, নরম জাজিম ছুয়ে
ভেসে উঠা ভোরে, কেটে যাক আরো কিছু আবাদ সময়।



আমাদের দীর্ঘ সাক্ষাতকার বিষয়ে

আমাদের দীর্ঘ সাক্ষাতকার পর্ব বলতে শীতকালটা ছিল
পৌষের আগে আগে যে রকম সন্ধ্যা নামে
ভেঁজা কুয়াশা ঠোঁটে মেখে ঘর ফেরত পাতি হাসের দল;
শুকনো ধুলো উড়তে উড়তে আমাদের জানালায় উল্টে যেত
ঘরের পর্দা আরো বেশি ভারি হয়ে উঠলে-
আকাশের রঙটা একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে গেলে
আমাদের সাক্ষাত বলতে ঐ সময়টাই ছিল।

দরজার বাইরে ঘুমিয়ে পড়তো মেটো আলো
খরচার ভয় ছিল
তবু সঙ্গম মুখর হাওয়া আরো বেশি ব্যাকুল হয়ে উঠলে
দেয়ালে লেপ্টে থাকা হাস্নাহেনার গন্ধ শুকে শুকে ভ্রমণে যাওয়া যেত
আমাদের সাক্ষাত পর্ব বলতে ঐ সময়টুকুই ছিল।

গতবার যখন আলোটা নিভে গেল ভোরের আগে
দেয়াল ঘামতে ঘামতে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলো,
সূর্যটা এত আলসে ছিল যে জোনাকিরা গাইল নাদাইর গীত
আমরাও জড়তা ভেঙে শুনতে থাকলাম শিশির ঝরার শব্দ;
এইভাবে আমাদের সাক্ষাত শেষ হয়ে এল বলে
দারুণ শীতকালটা জমে গেলো।


তাই আর বলতে হয়না

তাই আর বলতে হয়না নদীর কথা
গোপন সুড়ঙ্গ পথে কে বা কারা আসে যায়
শৈবাল শরীরে লেগে থাকা অচেনা গন্ধে-
মহুয়ার বন কেন দুলতে থাকে- কিসের আশায়

বনেলা পাখির সুরে কে কথা কয়
কার চোখের পাড়ে উতলা নদী
কোন জানালায় ভেঙ্গে পড়ে ঝড়ের হাওয়া
বলতে হয়না কেমন রং ছড়ায় রংধনু রেখা
কেন দিন নেমে আসে উড়াল দুপুর নিয়ে-

অচেনা সারস ঠোঁটে ঝুলে থাকে মাছের শরীর
অনাগত চুমোর আঁচে জেগে উঠে উদ্বিগ্ন ফুল
পাহাড়ি আলে শুয়ে কে কে অঘোর নিদ্রা যায়
আর দ্বীধায় পুড়ে কেন নিঝুম বিভাসী চুল-



হত্যাংক

তোমাকে হত্যা করার আগেই আমার মৃত্যু হয়
মরার আগে বুঝেছিলে কি মৃত আমি
মৃতদের কথা বলতে নেই, তাই মরে যাই।

আমাকে হত্যা করার আগেই তোমার মৃত্যু হয়
মরার আগে জেনেছিলাম কি মৃত তুমি
মৃতদের চোখে দেখতে নেই, তাই এমন হয়।

আমাদের মরতে হয় বলে বেঁচে আছি
আর মৃতদের কোন প্রান নাই - মৃত্যু নাই।