একটা বানোয়াট স্বপ্ন ও একটা কালো পাখি | বেলায়েত মাছুম - বেলায়েত মাছুম একটা বানোয়াট স্বপ্ন ও একটা কালো পাখি | বেলায়েত মাছুম

একটা বানোয়াট স্বপ্ন ও একটা কালো পাখি | বেলায়েত মাছুম

 
A fabricated dream and a black bird by belayat masum

 

জানালার পাশে একটা পাখি বসে আছে। কালো পাখি, কাকের মতো দেখতে কিন্তু লাল ঝুটি। আমি চিনতে পারছি না। ঘুম ভাঙতেই পাখিটা চোখে পড়লো। আমার জানালায় পর্দা টাঙানো হয়নি, কবে টাঙাবো তার ঠিক নাই। একবার ভাবি টাঙাই, পরে আবার মনে হয় টাঙিয়ে কী হবে। বরং জানালার দিকে তাকালেই বাহির দেখতে পাচ্ছি, রঙিন আকাশ একেক দিন একেকভাবে আমার সামনে এসে হাজির হচ্ছে।
 
মেঘেরা উড়ে যাচ্ছে কোথায়? শব্দহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। কয়েকটা পাখি ওড়াউড়ি করছে, চিনতে পারছি না। আমি পাখি বিশারদ না, তবু কিছু পাখি আমি চিনতে পারি। সবুজ টিয়ারা কদমের ফুল খেতে পছন্দ করে, আমার পোষা টিয়া ছেড়ে দেয়ার পর জানতে পারি। একবার একটা ডাহুক পোষেছিলাম, এক ঝড়ের রাতে কে যেন চুরি করে নিয়ে গেল। কয়েক দিনের ভেতর ফিরেও পেলাম। আবার চোখ পড়ল লাল ঝুটি ওয়ালা কালো পাখিটার দিকে। আধো ঘুম চোখে বুঝতে পারছি না পাখিটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে কি না? আর আমিই বা কেন বারবার পাখিটার দিকে থাকাচ্ছি? পাখিটা কি আমাকে কিছু বলতে চায়, বুঝতে পারছি না। এসব ভাবতে ভাবতে আরো ঘুমানোর চেষ্টা করি।
 
ঘুম লাগার কতক্ষণ পর ঠিক জানি না,  স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। একটা খোলা দরজায় আমি দাড়িয়ে আছি, দরজার পরে আর কিছু নাই। সব শূন্য আর অন্ধকার কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি। দরজা দিয়ে আমি বের হলাম, শূন্যে হাটতে হাটতে একটা জানালার পাশে দাড়াই, জানালার পরেও কিছু নাই, শুধুই অন্ধকার। জানালায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল, দেখি অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে একটা গাভী আর থাকিয়ে আছে আমার দিকে। কাছে যেতেই গাভীটি ওড়ে অন্ধকারে মিলেয়ে গেল। আমি দৌড়ে দেখতে চাইলাম কোথায় গেল কিন্তু ধপ করে পড়ে গেলাম, পাহাড় থেকে ঝাপ দিলে যেমন পড়ে।
 
আমি পড়তে থাকলাম পাখি ওড়ার মতো করে। হঠাৎ খেয়াল হলো আমি একা পড়ছি না। পাশে একটা পাখি উড়ছে, কালো পাখি, লাল ঝুটি। মনে হলো সেই পাখিটা, যেটা আমার জানালায় দেখেছিলাম। পাখিটা আমার একটু সামনে গিয়ে হেসে উঠল, একটু চমকে উঠলাম, মনে হলো আমি যেন ঝুলে আছি শূন্যে। পাখিটার দিকে তাকিয়ে আমিও হাসার চেষ্টা করলাম আর মনে হচ্ছে পাখিটা কথা বলা শুরু করবে। কী কথা বলবে?
 
পাখিটাই প্রথম কথা বলে উঠলো- “আমাদের দেখা হয়েছিল যখন তোমার বয়স তেত্রিশ বছর ছিলো। একটা নদীর ধারে, আঙুর বাগানে। তুমি ফুল তুলতে গিয়েছিলে, আমি বলেছিলাম আঙুর ফুল দিয়ে কী হবে, ঐ ফুলেতো মালা গাঁথা যায় না? উত্তরে তুমি জানালে মালা গাঁথতে চাওনা, ফুলগুলো শুকিয়ে রেখে দিবে। আমাকে চিনতে পারছো?” আমি মনে করার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। একটা আঙুর বাগান, একটা নদীর ধার কিছুতেই মনে পড়ছে না। পাখিটা আবার বলে উঠলো “তোমার নাম” বলেই নাই হয়ে গেলো। অন্ধকারের ভিতর দিয়ে আমি পড়তে থাকলাম।
 
পড়তে পড়তে মনে পড়লো একদিন একজন জিগ্যেস করেছিলো আমার নাম কী, জানালাম শিমুল। নাম শুনে শে হেসে উঠলো, মৃদু কন্ঠে জানালো তার নামও শিমুল। আমরা কথা বলতে থাকলাম শিমুল নিয়ে। লাল লাল ফুলে ভরে যায় পাতাহীন গাছ। ফাল্গুনে রং লাগাতেই যেন শিমুল ফোটে। কথা বলতে বলতে একটা গাছের নিছে দাড়ালাম, সবুজ পাতা ভরা গাছ, পাখিদের কিচিরমিচির শব্দকে ম্লান করে আমাদের শব্দগুলো মেতে উঠলো। আবিষ্কার করলাম আমাদের কথাগুলো শুধু হাওয়ার সাথেই ওড়ে যাচ্ছে না, বরং আমরাও যেন হাওয়ার ভরে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উড়তে আছি।
 
কথার ফোয়ারা একদিন থেমে যায়, কেন যায়? অতল শূন্যে পড়তে পড়তে মগজে কী স্মৃতি উকি দিয়ে গেল। অন্ধকার ভেঙে পড়ছি আমি। হঠাৎ মনে হলো শুন্যে আটকে আছি, মনে হয় মেঘের সাথে ধাক্কা খেলাম। মেঘেরা কি অন্ধকারে ভয় পায় না? মেঘেরা এত ওড়ে কিন্তু কোথাও যায় না, অদ্ভুত! পৃথিবীতেই ঝরে পড়ে আর আমাদের মতো মানুষদের ভিঁজিয়ে দেয় আর আমাদের শরীল জ্বর ঘোরে পড়ে যায়। আমরা বৃষ্টিতে ভিঁজতে ভিঁজতে কথা বলতে থাকি।
 
মানুষ আসলে একটা কথা বলা যন্ত্র। বানিয়ে বানিয়ে দিন রাত কথা বলতে থাকে। কথা গুলো কোথা হতে আসে, মগজ, না মন থেকে? আমরা কথা বলছি বৃষ্টি নিয়ে। বৃষ্টি কেন ফোট ফোটা পড়ে? কোন মীমাংসায় যেতে পারলাম না। আর এদিকে বৃষ্টি পড়া শেষই হচ্ছে না, হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাতেই চমকে দেখি শিমুল আমার পাশে নাই। ঘুম ভেঙে গেল, বিছানায় শুয়ে আছি একা। বারবার মনে পড়তে লাগলো শিমুল আমার পাশে নাই। তার কথা ভাবতে ভাবতেই আবার চোখ পড়লো ছোট্ট একটা জানালার দিকে। কিন্তু জানালাটা চিনতে পারছি না, বিছানার দিকে চোখ পড়লো, বুঝলাম অপরিচিত একটা বিছনায় আমি শুয়ে আছি। শুয়ে শুয়ে ছোট জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করি। বাইরে গাছের সবুজ পাতারা দুলছে, পাতার ফাঁক দিয়ে একটা কালো পাখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
 
পাখিটা কী আমায় কিছু বলতে চায়?
 
এমন ভাবতে ভাবতে মনে হলো, আমি তো পাখির ভাষা বুঝিনা। আবার তাকালাম জানালার দিকে, পাখিটা নাই। আশ্চর্য এমন হচ্ছে কেন। পাখিটার নাম জানা থাকলে ডাক দেয়া যেত, কিন্তু ডেকে কী বলতাম? ঘুম ঘুম চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, মনে হলো হঠাৎ ঝাপটা হাওয়া এসে আলোটা নিভেয়ে দিলো। আবার অন্ধকার, হাটতে হাটতে একটা জঙ্গলের ভেতর ডুকে গেলাম। গভীর জঙ্গল, অচেনা গাছগাছালি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে, নতুন প্রেমে পড়া যুগলের মত। আমাকে দেখে হাসার কী আছে বুঝতে পারছি না।
 
হাসির শব্দ ভেঙে শুনতে পেলাম কেউ যেন আমার দিকে আসছে। একটা ছায়া পাশ দিয়ে চলে গেল। মনে হলো কোন পথ হারা হরিণ, হয়তো ভুল করে আমার সাথে সাক্ষাৎ করে গেল। হাটছি তো হাটছিই, জঙ্গল আর শেষ হচ্ছে না। আমিতো কোথাও যেতে চাই না, তবে এত হাটছি কেন? দাড়িয়ে পড়লাম আর একটা নদী তার কুয়াশা ভেঁজা তীর আমার পায়ের নিচে মেলে দিলো। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি জলের দিকে। অসংখ্য মাছ আমাকে দেখতে এসেছে আর মাছগুলো আমার উপর ঝাপিয়ে পড়লো।
 
চমকে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। বসে পড়লাম বিছানায়, পুরো ঘর ভর্তি আলো আর দেখতে পেলাম পরিচিত অপরিচিত দশ বারোজন মানুয় আমার দিকে অবাক তাকিয়ে আছে। জিগ্যেস করলাম আপনারা এখানে কেন, তারা মুচকি হেসে উত্তর দিলো, এমনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে পড়লো দুপুরে খাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

 

১৯ মার্চ, ২০২৫
লিসবন

 

 

 

 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ