শব্দের ধারে মেতে মগজ |
পৃথিবীর অন্যান্য শহরের মতো, নভেম্বর এলেই বার্মিংহাম
শহরের রোদ উষ্ণতা হারায়। মনে হয় শহরের উপর সূর্য্যটা মান করেছে। অনেক সময় দুপুরেও সূর্য্যটারে
দেখা যায় না। কুয়াশের আড়ালে বসে কারে খুঁজতে থাকে? এমন জিগাংসা আমার মনে উদগত হয়। আমি
হাটতে থাকি পৃথিবীর এক শহর থেকে আরেক শহরে। হাটতে হাটতে বার্মিংহাম শহরের কোথাও দাড়াই।
কোন অপেক্ষা কিংবা উৎকন্ঠা ছাড়াই বসে পড়ি পার্কের বেন্চে। মাথার ভেতর বয়ে যায় শব্দের উতাল নদী।
কুমড়োর বাগানে পড়ে আছে একটি লাশ। প্রাণ আছে এমন লাশ।
বাগানে শাদা শাদা ফুল। আমি কোন ঘ্রাণ পাচ্ছি না। লাশটির সাথে কথা হল আমার, জানালো সে
ঘ্রাণ পাচ্ছে! আশ্চর্য্য! আমার নাক বন্ধ মনে হয়। নভেম্বর এলেই এমন হয়। হালকা শীত শহরে
নামার সাথে সাথেই আমার নাকের ঘ্রাণশক্তি কমে যায়। কেন এমন হয়? আমি জানতে চাই, আবার
চাইও না।
বাগান পেরিয়ে হাটতে থাকি নদীর দিকে। লাল ফড়িং-এ ভরা
এক নদী। এই নদীর পাড়েই কুমড়োর বাগান শেষ হয়তো। এই নদী তীরেই হয়তো লাশটি আসে তৃষ্ণা
মেটাতে, কিন্তু এই নদীতে কোন পানি নাই, শুধুই লাল ফড়িং। ছোট ছোট ডানায় হাওয়া লাগিয়ে
উড়তে থাকে। হাওয়া ভর্তি ঘাম ও বীর্য, যা বেহেশতের দরজা ছেড়ে আমাদের পৃথিবীতে ফিরে এসেছে।
আর আমি এই নদী তীরে বসে লাল ফড়িংগুলো দেখছি। আকাশে বজ্রপাত হল, দিগ্বিদিক দুলতে দুলতে
দু’টো ফড়িং দুধের সমুদ্রে ডুবে গেলো। ঐখানে, সমুদ্রের গভীরে শুয়ে আছে হরিণচোখা এক দেবী।
দেবী চোখ মেলে তাকালেন। খোপায় বেঁধে রেখেছেন আস্ত
একটি চাঁদ। পায়ের কাছে পড়ে আছে মোমের ভগ্নাংশ। এক হাতে আছে একটি সবুজ আপেল, আরেক হাতে
ধরে আছেন জ্যোৎস্নার ফিতা। আমার ছেড়া নাভি এই সুতোয় বুঝি সেলাই করা হবে। দেবী হাত বাড়িয়ে
দিলেন, সমুদ্রের জল ভেদ করে আমার নাকে স্পর্শ করলো হাস্নাহেনার ঘ্রাণ। খেয়াল হলো, তার
গলা জড়িয়ে আছে সাড়ে তেত্রিশ বছর পূর্ণ করা উতাল এক হাস্নাহেনার গাছ। গাছটির ডালে বসে
আছে এক নিঃসঙ্গ ময়ুর। ময়ুরের শরীর থেকে ঝরে
পড়লো একটি রঙিন পালক।
পালকটি উড়ে যাচ্ছে মাদারীপুরের স্তনের দিকে।
সমুদ্র থেকে দূরে, আবার অত দূরে নয় এক বন্দর আছে।
বন্দরের কোন কোন দোকানে বিক্রি হয় ধনেশের কারুকাজ করা ঠোঁট। মানুষে মানুষে আনন্দ কথা, হাওয়ার দেয়াল ছিন্ন করে
ভেসে আসছে ধণেশ পাখিটির কান্নার সুর। মানুষ এমন কেন? বৃষ্টির ভেতর হাটতে গেলেই কোন
না কোনভাবে ভিঁজে না যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু
যখন সমুদ্র পাড়ে হাটতে যায়, হাটতে হাটতে পা লবণ জলে ডুবিয়ে রাখে।
হায় আয়না! বর্ষার জলের উপর গড়িয়ে পড়ছে ছায়ার মাংস।
বিদ্যুৎ চমকায়, মেঘের সাথে মেঘের কথা হয়। দূরে দূরে, কয়েক কোটি তারা চুম্বনহারা। নিজের
মত করে ঝলসে যাচ্ছে চাঁদের মাংস। আমার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে নিশিভোজ। ক্ষিধে নাই,
তবু খাই খাই হৃদয় নিয়ে হাজির হই, জমিয়ে রাখা কালস্বপ্নের গুহায়।
আমাকে ডাকতে তুমিই এলে, আজ এই পূর্ণিমার রাতে। কফিনের
ভেতর শুয়ে দেখতে পাচ্ছি তোমার কাগজের মুখ। কুয়াশা ডিঙিয়ে পরতে চাইছো ঘাসের নুপুর,
আমার কঙ্কাল হাতে। তুমিও শুনতে পাচ্ছো, জৈন্তার পাহাড় ডিঙিয়ে ডাকছে মেঘালয়, আয়, আয়,
আয়। আমার পায়ে বেড়ি, মায়ার কঙ্কাল হয়ে ঝুলে আছি কোন তদবির ছাড়া। পৃথিবীর অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ছে জোনাকিআলো। শীতে মর্মর পাতাগুলো ভয়ে
আছে, আবার কখন বিদ্যুৎ চমকায়। খাঁচার ভেতর রঙিন পাখি। কতিপয় চাতক মানুষ অপলক তাকিয়ে
আছে সমুদ্রের দিকে।
পৃথিবীতে আরো কত শত দুই হাজার বছর কেটে গেছে।
কার্ডিফ শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তুষবৃষ্টি। নভেম্বর
শেষ শেষ। তীব্র শীতের ভেতর শুয়ে আছে একখানা কাটা হাত। সারারাত পাহারায় থাকে ঘোর লাগা
পলাতকপ্রায় চুম্বন। আমার ঘরের দেয়ালে নাই জানালা। তবু অন্ধ চোখে মুখে লেগে যাচ্ছে হাস্নাহেনার
ঘ্রাণ। একটি ছায়া পাশকেটে চলে গেল উদাসীন করিডোর ধরে। শুনতে পাই, মনে হয় শুনতেই পাই
বাতাসের বিলাপ। আমার আঙ্গুলগুলো ছুটে যাচ্ছে, গলে যাওয়া মোমের দিকে। উষ্ণ ঢেউয়ের মাঝ
দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে থামি।
তোমার সঙ্গে হয়তো দেখা হয়েছিল, নয় গুন তিন বছর আগে। মাতামুহুরী নদী তীর ধরে হেটে যাচ্ছে তীব্র শিশির আর আত্মহত্যা প্রবণ দীর্ঘশ্বাস। আমার ঘরের ছাইদানী ভরে আছে নিকোটিন ফুলে। সারারাত জেগে থাকি, শীত শীত লাগে। মাঝে মাঝে তন্দ্রার ঘোরে দেখতে পাই শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। নরকের এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে রঙিন প্রজাপতি। আর একটা অন্ধ বাদুর গান গেয়ে ফিরছে আমারই জানালার পাশ দিয়ে।
জবার স্তুপ পেরিয়ে
উদ্বাস্তু নক্ষত্রের দিকে।
আমার আত্মা
আমার শীতে ফাটা পা নিয়ে।
দূরে দূরে
তারাদের ফুল, মিতালী মুখর হাওয়া,
হৃদয়ের গোপন হু হু পাখি নিয়ে
পালিয়ে বেড়াচ্ছি
পালিয়ে বেড়াচ্ছি
পালিয়ে কোথায় যাব আর।
সমুদ্রে সিথান
গোপন জোনাকিরা ডাকতে আছে
পোষা অন্ধকার।
বাগানে ফুলের বাজার
তোমার অর্ধেকও পাচ্ছি না আমি।
কুচি কুচি করে ভাসিয়ে দেই স্বপ্নের দেরাজ।
ওহ আমার কালান্তর মায়া
পড়ে আছো বিলাসের অশ্রু ধরে
আর এদিকে
আজ রাতে
অন্ধ অন্ধ চোখে মাছগুলো
সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গেলো।
অতিতন্দ্রায় ডুবতে থাকি।
নভেম্বর /লিসবন
পিডিএফ ডাউনলোড লিংক: https://bit.ly/3V73kfe
0 মন্তব্যসমূহ