শুন্যতা যেভাবে আমার হয় | বেলায়েত মাছুম

শুন্যতা যেভাবে আমার হয়- বেলায়েত মাছুম

১.
আজ ছোট বোন মারজানার বিয়ে। আমার কেমন লাগছে? খারাপ, ভাল দুুটোই। আসলে কেমন লাগছে বুঝাতে পারবোনা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার বুকটা শুন্য হয়ে গেছে বা বুকের ভিতরে গভীর শুন্যতা। যেখানে কোন তল নেই, তলের কোন সীমারেখাও নেই। মনে হয় একবার আমার বোনটারে জড়িয়ে ধরিমনে হয় যদি একবার জড়িয়ে ধরতে পারতাম, শুন্যতা হয়তো একটু কমতো। কিন্তু তা হবার নয়। আমি কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারিনা।

এমন শুন্যতার মুখোমুখি প্রথম যেবার হই তখন আমার বয়স ছিলো হয়তো দশ বা এগারো, ঠিক মনে নাই। সেই সময় শুরু হলো বাড়িতে আমি চিনিনা এমন লোকের আসা-যাওয়া। লোকদের আসা-যাওয়া দেখতে দেখতে একদিন শুনি বড় বোনের বিয়ে। মনে আনন্দ নিয়ে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে থাকি। বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসতেই বাড়ি ভরে যেতে লাগলো মেহমানে। তখনো বুঝতে পারিনি শুন্যতা কী।

বিয়ের দিন, বাড়ি ভরতি মেহমান আর আনন্দ। আমি নিজেও আনন্দে ছিলাম। বর আসলো, তবে কেন যেন আমি তার সাথে মিশতে যাইনি। দুপুরের পর থেকে আমার আনন্দ আর থাকলো না। মনে হতে থাকলো বাড়ি ভরতি মেহমান, বর, বরযাত্রি এরা প্রত্যেকেই নিষ্ঠূর— আমার বোনকে নিয়ে যেতে এসেছে। ভিড়ের মধ্যেই আমি একা একা হাটতে লাগলাম আর বিশেষ করে আব্বাকে মনে মনে বকা দিতে থাকলাম। তিনি কেমন মানুষ যে আমার বোনকে অন্যের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে চায়। আমাদেরতো কোন সমস্যা নাই— আমার চিন্তার যেন শেষ নাই। মন খারাপ নিয়ে ঘুরেতে থাকি একা, কেউ আমার দিকে থাকায় না, আমিও কারো দিকে থাকাইনা। ভাবতে থাকি আমার বোনও কেমন মানুষ যে সে চলে যেতে রাজী হয়ে গেল। আপা আর আব্বার উপর গোসা করে সেদিন আমি উপোস ছিলাম, তা কেউ জানেনা এমনকি আপার বিদায়ের বেলাও তার কাছে যাইনি, জড়িয়ে ধরিনি। এখনো আমার শুন্য বুকটা আরো শুন্য হয়ে উঠে আর সেদিনের স্মৃতি মনে করে শুন্যতাকে পুষি।

আজ আমার দ্বিতীয় বোনের বিয়ে কিন্তু আমার এই শুন্য বুকটারে কোথায় রাখি। গত দুই বছর ধরে আমি কারো সাথে কোলাকুলি করিনা, করতে পারিনা। কোলাকুলি করতে গেলেই মনে হয় আমি শুন্যতায় তলিয়ে যাচ্ছি। মনে হয় আমিই যেন শুন্য হয়ে গেছি। আজ আমার বোনের বিয়ে তাই আমার শুন্যতা নিয়েও কিছু আনন্দ দিতে চাই, কিছু বেদনা জমাতে চাই— আমার আরো কিছু শুন্যতা বাড়াতে চাই।

২.
শুন্যতা, মাঝে মাঝে আমার খুব দারুন লাগে। যখন বুকের বামপাশ শীতল হয়ে যায়, চারপাশ ভুলে যায় মস্তিষ্ক, মনে হয় নিজেকে নিজের থেকেও দূর, তখন সেই মানবিক পরিবশ উপভোগ করাই উত্তম। চারপাশে সবকিছু আছে অথচ সেখান থেকে নিজেকে বের করে অন্য কোথায় গিয়ে পৌছার চেষ্টা যদিও সহজ নয় তবুও সেই চেষ্টা করে শুন্যতায় তলিয়ে যাওয়া দারুণ এক ব্যপার।

গভীর এই শুন্যতা বোধটা গত দুই বছর ধরে আমার সাথে আছে। ঠিক করে বলতে গেল আব্বা মারা যাওয়ার দিন থেকে। এই শুন্যতা কেমন আমি বুঝাতে পারবনা, শুধু জানি এটা আমাকে কোথাও নিয়ে যায়, যেখান আমি চিনিনা কিন্তু চিনতে চাই, যেখানে আমি যেতে চাইনা তবু চলে যাই।

আব্বা মারা যাওয়ার আগ থেকেই আমি অনেক দূরে, এখনো আছি। আব্বা মারা গেছেন এই খবর পেয়ে আমি কাঁদতে পারিনি, যেন আমি বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। কারো সাথে তেমন কথাও বলতে পারিনি। সারাদিন একা একা হাটলাম আর শুন্যতা আমারে ডাকতে লাগলো। হাটি আর ভাবি, ভাবি আর হাটি শুন্যের ভিতর দিয়ে, কারণ তখন শুন্যতাই একমাত্র মাধ্যম আব্বার কাছাকাছি পৌছার।

শুন্যতার ভিতর হয়ে আমি আব্বার কাছে যাই, তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাই কিন্তু পারিনা। আব্বার বুকে বুক রাখি  তবু তার স্পর্শ পাইনা। আমি তলিয়ে যেতে থাকি মায়াবী অন্ধকারে, তলিয়ে যেতে থাকি তলের সীমা ছাড়িয়ে, তলিয়ে যেতে থাকি গভীর শুন্যতার কাছে। আমার থেকে নিজেকে নিয়ে সেই শুন্যতায় যেন পলাতক হই। এর থেকে আমি, আমাকে আর হারাতে পারিনা।



ওল্ডহাম
০৩/০৩/২০২০