১.
আব্বার সাথে আমার পরিচয় ছিলো? হয়তো ছিলো, হয়তো ছিলনা।
আব্বা ঘোড়া পছন্দ করতেন কিনা জানিনা কিন্তু ভয় পেতেন। শৈশবে ঘোড়ার পিঠে হয়তো চড়ে থাকতে পারেন আমার মতো। আমি একবার চড়তে সাহস করেছিলাম, অভিজ্ঞতার জন্যে। আব্বা ঘোড়ায় চড়ে চলে গেছেন দূর। আমি কল্পনায় দু'টি ঘোড়া পুষি- লাল আর সাদা। তারা জীবনের মতো চলমান আজো। শব্দে শব্দে ঘোড়া দু'টি ছুঠে যায় আব্বার কাছে। আব্বা ভয় পেয়ে দৌড়াতে থাকেন আমার কল্পনার ঘোড়াগুলোকে সাথে নিয়ে।
আমি ভিতু লোক। তবু ভয় পাওয়া আব্বার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়।
কোন ঘোড়ার পিঠে আমি চড়বো? এমন যখন ভাবছি- দেখলাম সাদা ঘোড়ার পিঠে আব্বা বসে আছেন। আমাকে নিয়ে তিনি কোথাও যেতে চান? লাল ঘোড়াটায় আমি চড়বো কিনা যখন ভাবছি, দেখলাম ঘোড়াটারে খুঁজে পাচ্ছিনা। স্বপ্ন সাধারণত এমনই হয়, তবুও আমি ভাবছিলাম ঘোড়াটারে খুঁজে পাওয়া দরকার। আমাকে কোথাও যেতে হবে, কিন্তু কোথায় যাবো?
আমি খুঁজতে থাকি, আমাদের উঠোনে। বারান্দা থেকে হাতে নাগাল পাওয়া যায় এমন দূরত্বে আছে এক ঝোপ জবা গাছ— ফুটে আছে অসংখ্য লাল লাল ফুল। সে সব ফুলের আড়ালে হয়তো লুকিয়ে আছে লাল ঘোড়া, আমি খুঁজতে থাকি। হাত লাগা মাত্রই ফুলগুলো যেন কিছু বলতে চাইলো! কিন্তু সে সব শব্দ কিংবা কথা শোনার মত সময় আমার নাই।
কয়েকটা ফুল ঝরে পড়লো আমার হাতের স্পর্শে— কুড়াতে লাগলাম, মাথা তুলে চারপাশে থাকিয়ে দেখি অগণিত ফুল। কুড়াতে থাকি আর আরো ফুল ঝরতে থাকে। কুড়াতে কুড়াতে আমি ঝড়ের কথা ভাবি— প্রায় সন্ধ্যায় ঝড় হলে আম কুড়াতে যেতাম, আব্বা নিজে যেতেন না, আমিও না। তবু মনে মনে প্রতি ঝড়ো সন্ধ্যায় আম কুড়াতে থাকি। কল্পনার আমগুলো সবসময় দারুণ হয়, এই ফুলগুলোর মত। লাল লাল জবা ফুল কোথায় রাখছি? আমার সাথে রাখার মতো এমন কিছুই নেই, তবুও রাখছি, কেন রাখছি সে কথা ভাবার ফাঁকে লাল ঘোড়াটারে মনে পড়ে যায়।
একদিন আমি যেন সেই লাল ঘোড়া ছিলাম। আমার পিঠে ঘোড়া, ঘোড়ার পিঠে আমি— এমন ব্যস্ত দিনে কত দূর হতে ফিরে এসে আব্বার মুখোমুখি হতাম। আব্বা তার সাদা ঘোড়া নিয়ে কোথায় যান সে খবর হয়তো আমি জানি, কিন্তু কোনদিন মুখোমুখি বসে সেই আলাপে আমরা মঁজে যাইনি।
আব্বা হয়তো— হয়তো জানতে পেরেছিলেন একদিন আমি লাল ঘোড়াটারে হারিয়ে ফেলব।
পৃথিবীর বাগানে-মাঠে-ময়দানে আমি খুঁজতে থাকি। কোথায় গেল সে ঘোড়া? যে পথ দিয়ে আব্বা তার সাদা ঘোড়া নিয়ে গেলেন সেই পথই বা কই? আমি হারিয়ে গেছি, না ঘোড়াটা? এমন দ্বীধা নিয়ে আমাদের উঠোন ছেড়ে আর কার উঠোনে যাই— এমন ভাবতে ভাবতে আমি নৌকায় চড়ে বসি!
২.
আমাদের ফুলের বাগান ছিলনা, ছিল শুধু এক ঝোপ জবা গাছ, সে কথাও আমি জোর দিয়ে বলতে পারিনা- ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সুগন্ধী কিছু ফুল গাছের জন্য। যে দিন মনে হলো আমার লাল ঘোড়াটা হারিয়ে ফেলেছি -হয়তো কোথাও চলে গেছে, ফিরে আসবে আবার- সেই থেকে জবা ফুল আমার প্রিয় হতে থাকল।
একদিন এক হিজল গাছের নিচে দাড়িয়ে আছি- মাথার উপর থোকা থোকা ফুল, কয়েকটা অচেনা পাখি- কথা বলা পাখি। তারা কি যেন বলতে চাইল। আমি তখন কিসে যে মগ্ন ছিলাম বুঝতে পারিনি। পাখি গুলো উড়ে চলে গেল। তাদের চোখে আমি দেখতে থাকি- বনের ভেতর একটা ঘোড়া কান্না করছে। উপর থেকে মনে হলো এটা সাদা ঘোড়া- আব্বার ঘোড়া। আমারই এক চেনা ঘোড়া কিন্তু কাঁদছে কেন? আব্বাতো তার সাথেই থাকার কথা।
পাখিরা চক্কর দিতে লাগলো- নিচে একটা ঘোড়া কাঁদছে- আব্বার সাদা ঘোড়া। কিন্তু আমার লাল ঘোড়াটা খুঁজে পাওয়া দরকার।
আমি খুঁজতে থাকি, একা। আব্বার সাথে দেখা হলে ভাল হতো। তার ঘোড়ায় চড়ে আমার ঘোড়া খোঁজা যেত। ঘোড়ায় চড়ে ঘোড়া খোঁজা দারুণ ব্যাপার হতো, কিন্তু কেউরেই আমার কাছে পাচ্ছিনা। পাখির চোখ হয়ে আমি উড়ছি- ঝোপ-ঝাড় ঘেরা জবা গাছ, ঝুল ফুলে সাঁজা হিজল গাছ, আব্বার ঘোড়া, সব, সবকিছু পেরিয়ে আমি যে কোথায় যাচ্ছি অথবা কোথাও যাচ্ছি কিনা এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার ঘুম ভেঙে যায়।
আমি যেন সেই পিপাসিত ঘোড়া। আব্বার সাদা ঘোড়া কিংবা আমার লাল ঘোড়া।
০৩/০১/২০২০
ওল্ডহাম
0 মন্তব্যসমূহ