দি শেক্সপিয়ার সেন্টার |
২০১৮ সালের আগস্টে সুযোগ হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বাড়ি ঘুরে আসার। ইংল্যান্ডে আসার পর থেকেই ইচ্ছে ছিল কোন একদিন সুযোগ পেলে দেখতে যাবো। কিন্তু সে সুযোগ আর আসেনা। আমরা যারা এই দেশে আছি- সকলেই কর্মে ব্যস্ত। ঘুরাঘুরির ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হয়না। সেই আগস্টে লন্ডনে যাওয়ার দরকার পড়লো। বার্মিংহামে থাকা বন্ধু মামুনের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত হলো যে লন্ডন থেকে ফিরে পরের দিন সকালে শেক্সপিয়ারের বাড়ি দেখতে যাবো। লন্ডনেও আমাদের কয়েক জায়গায় ঘুরার সুযোগ হয়- বিশেষ করে ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম ও রয়েল অভজারবেটরি গ্রীনউইচ।
২৬ আগস্টে ওল্ডহাম ম্যানচেস্টার থেকে ট্রেনে করে গেলাম বার্মিংহাম, ওখানে আমার বন্ধু মামুনের বাসায় উঠলাম। ২৭ তারিখে গেলামে লন্ডন, যে উদ্দেশ্যে যাওয়া তা পুর্ণ না হলেও ঘুরতে লাগলাম- আমরা দেখতে গেলাম ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম, ওখান থেকে হাটতে হাটতে পৌছে গেলাম রয়েল অভজারবেটরি গ্রীনউইচে। হাটার সময়ও অনেক কিছু দেখা হলো।
ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়ামে দেখতে পাই- ব্রিটিশদের জাহাজ আর নাবিকদের ইতিহাস। তারা কিভাবে জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পরতো পৃথিবী জয়ের নেশায়। জাহাজ আর নাবিক এবং যোদ্ধা। রক্তের ইতিহাস।
ইনকা শনিবেয়্যারের তৈরী- বোতলে নেলসনের জাহাজ । |
দিনে দিনে লন্ডন থেকে বার্মিংহামে ফিরি। ২৮ আগস্ট সকালে দুই বন্ধু মিলে রওয়না দেই শেক্সপিয়ারের বাড়ির উদ্দেশ্যে- স্ট্রেটপোর্ট আপন অ্যাভনে। বারোটার দিকে গন্তব্যে পৌছাই। ছোট্ট শহরে ঢুকেই চমক- প্রায় সব কিছুই পুরনো শত শত বছরের। ঘরের কাঠের দেয়াল, কাঠামো- যত্নে রাখা। অনেক গুলো নতুন দালানও আছে কিন্তু এমনভাবে সাঁজানো যে মনে হয় ওগুলোও পুরনো সময়ের অংশ।
শেক্সপিয়ারের শহর- স্ট্রেটফোর্ড আপন অ্যাবন |
শেক্সপিয়ারের পুরনো বাড়ির সামনে |
শেক্সপিয়ারের বাড়িতে ঢুকার জন্য টিকেট কাটতে হলো। টিকেট সম্পর্কে ছোট্ট তথ্য হলো- পূর্ণ বয়সী লোকের টিকের দাম ২২.৫০ পাউন্ড, মেয়াদ থাকে ১ বছর। এই টিকেটে শেক্সপিয়ারের পুরনো বাড়ি, নতুন বাড়ি, যাদুঘর, স্ত্রী অ্যানের কটেজ, মা মেরী অ্যারডেনের খামার, কন্যা সুসানা ও জামাতা জন হলের বাড়ি ঘুরা যাবে, যতবার ঘুরতে ইচ্ছে হয়।
ঘুরতে লাগলাম তাঁর বাড়িতে- প্রথমে গেলাম পুরনো বাড়িতে, যেখানে শেক্সপিয়ারে জন্ম। প্রথমেই চোখে পড়ল একদল নাট্যকর্মী- যারা শেক্সপিয়ারের নাটকের চুম্বক অংশ দর্শনার্থীদের উদ্দশ্যে প্রদর্শন করছিলেন।পুরনো ঘরে- যেখান তাঁর জন্ম- ঢুকতেই দু'জন স্বেচ্ছাসেবক অভ্যর্থনা জনালেন। তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারলাম শেক্সপিয়ার ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। তাঁর বাবা ছিলেন তৎসময়ের প্রকৌশলী, যিনি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস- হাত মোজা, ঝাড়ু, রান্নার সরন্জাম ইত্যাদি তৈরি করতেন। ধীরে ধীরে ভেতর দেখতে লাগলাম- তাঁর আঁতুর ঘর, শোয়ার ঘর।সবকিছু পুরনো- রান্নাঘর, শোয়ার ঘর দেখে মনে হলো তখনও তাঁরা এখনকার আমাদের চেয়ে উন্নতিতে এগিয়ে ছিলো।
প্রথমেই পড়লো রান্নাঘর, সাথে খাবার টেবিল পরিপাটি করে রাখা। মনে হবে খাবারের জন্য সবকিছু তৈরি। পাশের কক্ষ ছিল তাঁর বাবা জন শেক্সপিয়ারের কাজ করার জায়গা, যেখানে দেখতে পাই হাতে তৈরি হাত মোজা, ঝাড়ু সহ আরো সরন্জামাদি। সিড়ি দিয়ে উঠেই শোয়ার কক্ষ-১৫৬৪ সালে যেখানে শেক্সপিয়ারে জন্ম হয়। বড় পালংকের পাশে ছোট একটা বাক্স, প্রদর্শকের বর্ণনায় জানা যায় যে শিশুকালে শেক্সপিয়ারকে ঐ বাক্সে (Bedside Baby Crib) রাখা হতো। জন শেক্সপিয়ার আর মেরী অ্যরিডেনের আট সন্তানের মধ্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ছিলেন তৃতীয়।
এই পুরনো টেরেস বাড়িতেই উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের শেক্সপিয়ার হয়ে ওঠা। এখানে বসেই তিনি নাটক লিখে জনপ্রিয়তা পান। আমি কল্পনায় দেখতে থাকি- শেক্সপিয়ার তার জানালায় বসে লিখতে শুরু করেছেন আর বাইরে ওপাশের পানশালায় লোকের জটলা- মারামারি, রাস্তায় ঘোড়ার ঘাড়ি। এই বাড়িতে শেক্সপিয়ার অ্যান হ্যাতওয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং প্রথম পাঁচ বছর এখানেই কাটান।
পরবর্তীতে তিনি যখন জনপ্রিয় আর ধনী হয়ে উঠলেন তখন পুরনো বাড়ি থেকে কিছু দূরে অভিজাত এলাকায় নতুন বাড়ি কিনে চলে যান। পরে পুরনো বাড়িতে Swan Maidenhead নামে পানশালার (Pub) ব্যবসা শুরু করেন।
শেক্সপিয়ারের পুরনো বাড়ির সদর দরজায়। |
পুরনো বাড়ি থেকে একটু হেটে গেলেই নতুন বাড়ি। সদর দরজা বন্ধ থাকলেও পাশেই দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশ দুয়ার আছে। সেখানেও প্রদর্শকরা সংক্ষেপে বর্ণনা করেন বাড়ি সম্পর্কে। ১৫৯৭ সালে এই বাড়িতে আসার পর থেকে ১৬১৬ সালে এই বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বাস করেন। ১৭৫৯ সালে এই বাড়ি ভেঙে ফেলা হয় এবং তাঁর স্মৃতি রক্ষার্তে সেখানে বাগান তৈরি করে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়।
আমরা তাঁর নতুন বাড়ির বাগান দেখতে লাগলাম। বিশাল সীমানা ঘেরা সবুজের সমারোহ। এই বাগানে আছে শেক্সপিয়ারের হাতে লাগানো গাছ আর আছে শেক্সপিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ কাজের উপর করা নানা রকমের আর্ট ও মূর্তী।
যে চেয়ার-টেবিলে বসে শেক্সপিয়ার রচনা করতেন |
শেক্সপিয়ারের হাতে লাগানো গাছের সামনে মামুন। |
নতুন বাড়ি থেকে বের হয়ে- প্রায় দশ-পনের মিনিট হেটে পৌছে যাই হল'স ক্রফটে, শেক্সপিয়ারের মেয়ে ও জামাতার বাড়ি। ১৬১৩ সালে মূল বাড়ি তৈরি হয় এবং পরে ধীরে ধীরে পরিবতর্ন আনা হয়। বিশাল সে বাড়ির মালিক জন হল পেশায় ছিলেন ডাক্তার। তাঁর বাড়ি দেখে মনে হলো ডাক্তাররা সব কালেই ধনী হন। জন হল ধনী আর অভিজাত হলেও তিনি সবাইকে সমান সেবা দিতেন, ধনী, গরিব, ক্যাথলিক, প্রোটেস্টেন্ট বলে আলাদা করতেন না। ১৬৫৭ সালে লেখা তার বই অন্যান্য ডাক্তাররা অনুসরণ করতেনা। সুসানা আর জনের একমাত্র কন্যা এলিজাবেতের জন্ম হয় এই বাড়িতে।
শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর পর সবকিছুর দখল উত্তরাধিকার সুত্রে সুসানার কাছে চলে যায়, পরে যখন সুসানার মৃত্যু হয় এলিজাবেত সবকিছুর দখল পান। এলিজাবেতের কোন সন্তান না থাকায় তার মৃত্যুর পর সবকিছুর দায়িত্ব চলে যায় শেক্সপিয়ারের বোন জোয়ান হার্টের কাছে। ১৮৪৭ সালে The Shakespeare Birthplace Trust হার্ট পরিবারের কাছ থেকে সবকিছু কিনে নেয়।
সময় স্বল্পতার কারণে শেক্সপিয়ারের স্ত্রী অ্যানের কটেজ, মা মেরী অ্যারডেনের খামার ঘুরে আসতে পারিনি। আবার কোন দিন যদি সুযোগ হয়- হয়তো ঘুরে আসবো আবার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বাড়ি।
বেলায়েত মাছুম
ওল্ডহাম/২০১৯
ওল্ডহাম/২০১৯
0 মন্তব্যসমূহ