ও জুলাই | বেলায়েত মাছুম



আজ ১৭ জুলাই। এই দিনে আমার পৃথিবীতে আগমন হয় আর এতদিন ধর আনন্দ নিয়েই বেঁচে আছি। আমি কেউ না- শুধু কবিতা লিখি। পৃথিবীর ঘড়ির প্রতি আমার দূর্বলতা আছে। 


আজ আরো একজন মানুষের জন্মদিন। পৃথিবীর হাওয়ায় যতদিন আওয়াজ বাঁজবে তার  সুর- তার কথা- বেঁচে রবে। এই কবিতাগুলো তাঁরেই- প্রিন্স মাহমুদকে উৎসর্গ করছি।



ঘড়ি

কার বাড়ি তুমি ফিরে যাবে ঘড়ি, বাতির ছায়ার নিছে
শুয়ে আছে ঝড়। অকাল পুরান সেই নদী তীর বেয়ে
তোমারেও যেতে হয় ঘর। কালো পাখির বাসা থেকে দূর- 
আগত ফুলের সুরভি ঝরে। পিনের মতোন এক তীব্র আঁধার, 
ছুয়ে যায় ঘড়ি সেই ম্লান ভোরে।


সময়

শোনা যায় ঘরে পোষা ডাহুকের গান, পতিত বিলের
পাড়ে বসে এক সন্ধ্যায়; নিয়ত ফেরার ঘোরে ডাহুক
বাঁজায় পুরাতন মন্দিরায় সেই মনলোভা আওয়াজ।
ঘরের দেয়াল জানে কত কাছাকাছি বুক পেতে রয়
পুরাতন ঘড়ির ভিতর এক কলের হৃদয়, শুনা যায় শুধু
দরিয়ায় গান, পলকে মুছে যায় মনোহরি কারুকাজ। 


একদিন

একদিন তারে ভালবেসে ফেলি- কতদিন গেল
কতদিন তারে নাম ধরে ডাকি, গোপন যত ফুলের নামে;
পাখির ঠোঁটের কাছে যত কথা হয়, যত আবৃত শামুক শরীর
হেটে যায় বুকের আলপথ দিয়ে- সে খবর কেউ রাখেনি, আমিও না জানি।
আমার গোধূলীতে বসে সে গেয়ে যায়
অনন্ত পথের ধুলোর মিছেলে কেবল হেটে যায়
এইখানে একদিন যে সুরে বেহুলা কাঁদে- লখিন্দর কাঁদে
গৌড় রাজার প্রাক্তন স্ত্রীর চুলের সিঁথি রেখা ধরে-
মনে হয়ে তারে নাম ধরি ডাকি- একদিন নদীর দিকে
হাওয়ার সুরে ভুলে যাই নগরী আলোর কোলাহল নিনাদ।



ইশ্বর

ইশ্বর দরোজা খুলে দাড়ান এবং অবশ্যই তিনি হেসে উঠেন
আর চোখ নেই বলে কাঁদতে পারেন না;
দরোজা সাধারণত ঘরের হয়, ঘরেরা মাঝে মাঝে ভ্রমণে যায়
মানুষেরা ঘুমিয়ে গেলে আগর বনে, ইশ্বর তালি বাজান বেহাল সেতারে।


ফুল

ফুল কে ভাবা যায়। রাত কিংবা সন্ধ্যার কথাও। দেয়াল কে
শুনানো যায় পুরনো দিনের গান। মফস্বল ঘুরে এসে একটি কবিতা
অথবা অন্তত প্রেমিকার ঠোঁট মনে করে চুমু খাওয়া যায় ভেঁজা ঠান্ডা
গেলাসে। আমার কোন প্রেমিকা নাই, তবুও তার কথা ভেবে সমুদ্র,
নোনাজলে ডুব দেয়া যায়। পর পর তিনরাত একই স্বপ্ন,
একই ভাবে জেগে উঠা যায়, জল পিপাসায়।


নৈশ সভা

নৈশ সভায় কোন গল্প হয় না
পরস্পরের খোঁজ-খবর কিংবা পাখির কথা;
নিশিতে যে ডেকে উঠে জানালার পাশে
ঘাস কাটা যন্ত্রের শব্দ নিয়ে-
তার কথা কোন দিন আমরা বলবনা।

সভার টেবিলে আঁকা ড্রাগন ট্যাটু
সূর্যের লালা নিয়ে নিবিষ্ট প্রার্থনায়;
সভা ঘরে জানালা ছিল না এবং কোন শব্দ।

রাত নেমে এলে বসে থাকি
শৈশব নিয়ে;
বারুদের গন্ধে
পিপাসা ও ক্ষুধায় মজে শুয়ে থাকি
সভা শেষে- ত্রাণের আশায়।


দ্বীধা

আমায় কখন ছুয়ে গেলে- হাওয়া
হিজলের বনে কখন তুমি ঝরে গেলে
সন্ধ্যায় একদিন মগ্ন ছিলাম- মনে পড়ে?
পথের কোন দিক ছিল না
আমাদের মত- ডুবে থাকার
নিজেদের ভেতর পতঙ্গ হয়ে।

আমায় ছুয়ে যায় হাওয়ার শরীর আর আমরা আমাদের
নিয়ে জেগে থাকি, কোন একদিন ভ্রমণে যাবো- হিজল বনে।

সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে?
হাওয়া আর জল?
যেদিন ঠোঁটের ভাঁজে পুড়ে গেল ফুল
লবণ বাগানে ঝুলে থাকলাম চাষীর স্বরুপ।


ক্যামেলিয়া

তোমাকে নিয়ে কোন গল্প নেই - ক্যামেলিয়া
তোমার সাথে কোন গল্প নেই
তোমাকে বসিয়ে রেখে কোন গল্প হয়না
কবিতা কিংবা বাৎসায়ন পাঠ - ক্যামেলিয়া।

ক্যামেলিয়া- তুমি প্রার্থনা জানো? মানুষ যে করে
তোমার প্রার্থনায় কারে ডাকো?  সে কি জানে?

শহরে বাতি নিভে আসে আলোয় আলোয়
সূর্যের মুখে চুমো দিয়ে জাগো ক্যামেলিয়া,
হাতের নখে, পায়ের নখে এঁকে দাও
এঁকে দাও নদী ও ঢেউ
মানুষের শরীর, শহরের মানুষ
এঁকে দাও যৌবনে ঝুলে থাকা রাত
প্রেমিকের বুক, এঁকে দাও পৃথিবীর পাঁজর
যেখানে ঘুমাতে চাও  কোটি কোটি চুমোয়
প্রেমের বারন্দায় বসে গেয়ে উঠো- ক্যামেলিয়া।



চোখ

সে এক আশ্চর্য বেকুব চোখ;
মাছের চোখের মত জলের ভেতর
হামাগুড়ি দিয়ে খোঁজে পাতাল বুক।

কোথাও কোন স্পর্শে নেই 
তার শরীর কিংবা চুল,
শুধু অদ্ভুৎ এক ঘ্রাণ;
নাকের ভেতর, মনের দেয়াল জুড়ে
দেয় মাছরাঙা স্নান ।
তার প্রবাল শরীর ছুয়ে ঢেউ;
গ্রীবায় লেগে থাকা লবণ স্বাদ
নীল সমুদ্র ছাড়া জানেনি কেউ ।

[তবুও তার বেকুব লাল চোখ
হতচ্ছাড়া অদ্ভুৎ দুটি চোখ
সামলে উঠে ঝড়ে নত গাছের মতন।]

অথচ সহস্র কাল পরও
এক স্পর্শে জেগে উঠে মেঠো শরীর।



ফেরা

মনে হচ্ছে নিজের ভেতরেই ফিরছি-

নিজের বলে কিছুই ছিলনা,ঘুম কিংবা স্বপ্ন
অথচ ঘুমের ভেতর জেগে থেকেই ফিরছি।
ফেরার পথ ছিল বলে,আজ এই গল্পের রাত-
সমুদ্র রাতেও জাগে চাঁদের মতন,তবু
অন্ধকার ভাঙার শব্দে ঢেউগুলো কেমন যেন
অর্ধেক রমণীর মতো জেগে উঠে শৈবাল শরীর নিয়ে।

মনের ভেতর কুয়াশা জমে, তাই চোখেও অন্ধকার
ভাঙার শব্দ হয়,অথচ কথা ছিল মধ্যাহ্ন হাওয়ায়
চিলদের মত উড়ে, আকাশ দৃষ্টি সহ,পলকে
মাছের চোখের ভেতর ছায়া রোগ হই।

ফেরার পথেই ফিরতে হয়, ফিরছি বলে-

পথ জুড়ে মায়া, আর পিছনে পথ ধুলো
দৃষ্টিও যেন আটকে যায় আলোর ভেতর;
তবুও পিছনে তাকিয়ে কেবল ফেরার জন্য,
ফিরছিতো সেই বাষ্পীয় আদ্রতা মাখা যন্ত্রে চড়ে
প্রিয় ''বেলাভো'' শহরের দিকে।



চোখ ২

চোখের ভিতরেই চোখ রাখি
স্বর্ণ লতিকার মত ঝুলে থাকা চোখ, কুয়াশা দিনে
ঝরে পড়ে দূর্বা সবুজে সূর্য কণা,
ভাববার সময় হয়
একদিন এই মীন শরীর নিয়ে জেগেছিলাম
বস্তির পাশে, কেউ চোখ তুলে স্বপ্ন দেখিনি
চোখের ভেতরে চোখ রেখে
কুয়াশায় ভেঁজা দরপর বুকের উপর নেমে এসে
পুচ্ করে একটা দাগ টেনে, সরল কিংবা বক্র
কেউ বলেনি এখানে, এই দুধর্ষ রাতে
চোখের ভিতরে চোখ রেখে জেগে থাকা নিষেধ।



প্রেম

পাড় ভাঙ্গা নদী পাড়ে বসে থাকি
জলের কাছে কিছু চাইব বলে।

এরা সমুদ্রের মাতা
পাহাড়ের ফুল;
রমণীর মত কেঁদে উঠে বুকের পাশে।

আমরা নদী দেখতে যাই মধ্যরাতে
বাতাসের শব্দে কেঁপে উঠি আচমকা
রুপালী জলের উপর নেমে আসে চাঁদ
দেখতে থাকি তাদের অপলক চোখে।

আমরা বসে থাকি সূর্য ডুবা দৃশ্যে
দেখতে পাও?
জলের উপর ছায়া
ছুতে পারো?
ভাঙ্গা পাড়ের মতো শুয়ে পড়ি যখন তখন।


হত্যাংক

তোমাকে হত্যা করার আগেই আমার মৃত্যু হয়
মরার আগে বুঝেছিলে কি মৃত আমি
মৃতদের কথা বলতে নেই, তাই মরে যাই।

আমাকে হত্যা করার আগেই তোমার মৃত্যু হয়
মরার আগে জেনেছিলাম কি মৃত তুমি
মৃতদের চোখে দেখতে নেই, তাই এমন হয়।

আমাদের মরতে হয় বলে বেঁচে আছি
আর মৃতদের কোন  প্রান নাই - মৃত্যু নাই।



বুড়ো সকালে

এই বুড়ো সকালে রাতের গল্প থামে
মোরগের ঠোঁটে নেমে আসে অবাক সূর্য্য;
মৃত পাখির পালক ছড়াতে ছড়াতে আমাদের উঠোন
পেরিয়ে গেলে- এই বুড়ো সকালে
গাভীর ওলান হতে পবিত্র উষ্ণতা ডাকে।

আমাদের গ্রামে এখন তুমুল বর্ষা-
হিজল ফলের মতো মানুষ
আর মানুষের মত প্রেম করে বেড়ায়
রাতের গল্পে ডুবা অন্ধ বাদুর।

সারারাত গল্প শেষে জেগে উঠে চোখ
প্রেমিকার হাতের মতো মলিন ধূসর চোখ।



প্রতিচ্ছবি

কোথাও কোন প্রতিচ্ছবি নেই, না আয়নায়, না জলে
তবু জানালার পর্দা ভেদ করে একটা অগোছালো  বিম্ব
ঢুকে পড়ে। কোথাও যাবার নেই, তাই ঘুমিয়ে পড়ি আমাদের
ভেতর, ঠোঁটের কাছে বক্রাকার ঘুরি পৃথিবীর মতো একই জায়গায়।

সেই সব বিছানাপাতি আমাদের ছিল না,
আমরা আমাদের ছিলাম কি না জানিনা।
তবু জেগে উঠে দেখলাম, জেগে আছে চোখ,
এই অন্ধকারে নিজেদের উপর। নিজেরা গল্প করি নিজেদের।

আহা!  এত সুর কোথা হতে এলো,
এই চুলগুলো এমন কেন
এমন ধূসর রঙ এই খয়েরী আলোয়?

এত অশ্লীল মুগ্ধতায় ভিঁজে নিজেদের গিলি
চিনব বলে আঙুলগুলো চিবিয়ে দেখি
জেগে আছি তাই চোখের উপর নেমে আসি।


পতন সংক্রান্ত

আমাদের পাড়ায় কোন মদের দোকান নাই অথচ নিজেকে
সব সময় মাতাল ভাবি। দখিন জানালায় বসে গান গাই, সন্ধ্যায়
প্রার্থনায় বসি। বন্ধুর সাথে বান্ধবীর গল্প আর পরকিয়া প্রেমের
টানে ছুটে যাই আদি গৃহতলে। আমি সংসারী হয়ে উঠি, বোকা
বাক্সের পর্দায় চোখ রেখে- পিঙ্গল চুল ওয়ালা নায়িকা দর্শনে ডুবে যাই।

আমাদের ঘরের দেয়াল এত নরম যে প্রতিদিন খসে পড়ে রং
করা আস্তর। ঘুলঘুলি দিয়ে প্রতিনিয়ত ঢুকে পড়ে গৃহত্যাগী
প্রবীন বায়ু। প্রকৌশলীর নোট থেকে জানতে পারি ইজা, জমার
প্রকৃত হিসাব, যদিও ঋণী বলে অনেক আগে থেকেই দেউলিয়া
খাতায় নাম উঠে গেছে। শুধু কোথাও কোন ছবি নাই বলে কেউ
চিনতে পারেনা।

পতনরত পাতারা কোন শব্দ করেনা - এমন মিথ্যে বয়ান করেছি
বহুকাল। শীত মৌসুমে শুকনো পাতার উপর পা রেখে জানতে
চেয়েছি পথের দূরত্ব। সন্ধ্যায় পাখিদের উড়াল দৃশ্যে দেখে কতবার
ভেসে গেছি সূর্য পানে। সুগন্ধি ফুলের সুবাসে মত্ত ভ্রমরের ডানায় চড়ে
ঘুরে বেড়িয়েছি বঁইচি বাগান। ঝুলে থাকা হিজল ফলের মতন দুলতে
থাকায় লোকেরা ভাবতো- নৌকায় বসিয়ে দিলে পৌছে যাবো
দরিয়ার পাড়ে।  


কবি বিষয়ক

কবিকে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও যেতে হয়। এই যেমন-
সকালের কোমল হাওয়ায় গা ধুয়ে আসেন কাসপিয়ান সাগর হতে
অথবা গোয়াল ঘরের বারন্দায় বসে শুকতে থাকেন গাভীর ওলান
হতে ভেসে আসা কোমল উষ্ণতা।

তার দিনের শুরু নেই বলে, শেষও নেই। কবি সব সময় পৌছে যান
তার নিজের আগে। ভাদ্রের রোদের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ান কাশফুল
বাগানে। যত্রতত্র ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস আছে, যদিও তার চোখ নেই
বলে কাদঁতে পারেন না।


কবি অন্ধ হলেও চশমা পড়েন অথবা চশমা পড়লেও তিনি ঝাপসা
দেখেন। তিনি শিশির ঝরে পড়ার শব্দ শুনতে পান। শুকনো পাতার
উপর হাটতে হাটতে পিয়ানো বাঁজান। 

একদিন একরাত করে রোগ বাড়তে থাকে। নিজের শরীরের ভেতর
শুয়ো পোকার মত- বেঁচে থাকার আনন্দ নিয়ে পান করেন গোধূলি
আলো। কবির হৃদয়ে কোন আলিঙ্গন নেই কিংবা পরস্পর কথা
বলার অদৃশ্য দেয়াল।

কবি কেন এত চোখের রোগে ভুগেন?


তবুও পৃথিবীতে ঠিকে থাকা অন্যান্য  বাষ্পযন্ত্রের মত কবিকে বেঁচে
থাকতে হয়, দেয়ালের আলোয় নিজের ছায়া হয়ে কিংবা ছায়ার ভেতর
এক আগুন্তুক তেলাপোকার রুপ ধরে, আর ক্ষয়ে যাওয়া চোখের
দৃশ্যে প্রতিদিন ডুবতে হয় একান্ত নিজস্ব জানালায়।