যেভাবে আমাদের হারিয়ে ফেলছি: স্মৃতি- সংস্কৃতি

      ছোটবেলার কথা খুব বেশি যে মনে পড়ে, এমন নয়। তবুও  মনে পড়ে, আহা!  কত সুন্দর আর সরল ছিল আমাদের জীবন। কতদিন পুতুল বিয়ে দিতে দিতে নিজেই বিয়ে করে ফেলতাম, মনে পড়ে  একবার আমার বউ বলল চারটা মরিচ আনতে, আমি চারটাই আনলাম। কি বকাই না খেলাম সে দিন, চারটার কথা বললেই চারটা নয়, পরিমাপ মতো আনতে হয়। নতুন বিয়ে করার ফলে মনে হয় বোকা বনে গেছিলাম। এইসব দিন বেশি দিন থাকেনা, তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। এই সময়ের অনেকেই হয়তো এমন স্মৃতি পাবেনা, তবুও স্মৃতি হবে সময়ের মতো করে। বড়দের সাথে যখন স্মৃতি নিয়ে কথা বলি- তারা বলেন তোমরা আর কি পেলে, আমাদের সময়ে কি না কি করেছি, তোমরা এসবের কিছুই পাওনি। হয়তো আমি বা আমরাও একদিন তাদের মতো বলব, আহ! ছোটবেলা, কি বেবুঝ শৈশব।

   অগ্রহায়ণ মাসের একটা দিন বিশেষ ভাবে পালন করা হয়, অনাড়ম্বর অনুষ্টান করে ধান কাঁটার সূচনা করা হতো। ঐ বিশেষ দিনের সকালে, ছোট ছেলে বা মেয়েকে কন্যা সাঁজিয়ে ক্ষেতে নিয়ে যাওয়া হত। আমার মনে পড়ে দুই বা তিনবার কন্যা সেঁজেছিলাম ঐ বিশেষ দিনে। একজনের কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হয়, সাথে কি কি থাকত ঠিক  মনে নেই, তবে এটা মনে আছে যে পিতলের বদনায় পানি নেয়া হত। কন্যার সাথে চার-পাঁচ জন যেতেন, ক্ষেতে অনুষ্টান শেষে কন্যা এক মুঠো ধান কাটতো,আর এর মাধ্যমে বছরের আমন ধান কাটা শুরু হত।পরে ঐ এক মুঠো ধান ঘরে ধানের গোলা'র সাথে বেধে রাখা হত। বিকেলে করা হত চিতল পিঠা,লাউপাতার শাক দিয়ে গরম গরম খাওয়া, মনে হচ্ছে এখনো সে ঘ্রাণ পাচ্ছি।

    পৌষেও আমাদের একটা বিশেষ দিন ছিল। আমরা বলতাম "বুলাবুলি"। এই বিশেষ দিনের জন্য আমরা সকল উত্তেজনা জমিয়ে রাখতাম। বাজারে যেতাম, মাটির খেলনা কেনার জন্য, "বুলাবুলি" উপলক্ষে প্রতি বাজার বারে বসত খেলনার মেলা।বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট ছিলাম ষাঁড়, ঘোড়ার প্রতি। ঘটি-বাটি ও কিনতাম। শুধু মাটির খেলনাতেই ভরে যেতে ভাড়। বাজার থেকে ফেরার সময় গর্বে বুকটা ফুলে থাকত এই ভেবে সবচাইতে সুন্দর ও বেশি ষাঁড় - ঘোড়া আমার দখলেই। তবে ষাঁড়-ঘোড়ার দখল নিয়ে দুই ভাই যে মারামারি করতাম না এমন নয়, প্রায়ই ভেঙে ফেলতাম। সে দিন বিকেলে সবচেয়ে বেশি দখল যেত ঘরের গরুদের, কারণ গরুর রোগমুক্তির আশায় কলা গাছের "পাচল" দিয়ে পেঠানো হতো।পরে তা ছড়িয়ে পড়ত বাড়িময়- দাদা, দাদী, ভাবী এইসব রস সম্পর্কের মানুষদের উপর।তখন হুলুস্থুল লেগে যেত, কে কাকে পেঠাবে এ নিয়ে।

     একবার, চাচাত ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে পাঠানো হলো কুটুম আনতে। রওনা হলাম, সাথে ফুফাতো ভাই। পথে মেলা, ঘৌড় দৌড়, এটা ফেলে যাই কিভাবে, সিদ্ধান্ত নিলাম কয়েকটা দৌড় দেখেই চলে যাবো, একটার পর একটা দৌড় শেষ হয় কিন্তু দেখা শেষ হয়না। বিকেল হয়ে গেল কিন্তু বিশেষ আকর্ষণীয় দৌড় এখনো বাকি, এতগুলো দৌড় দেখতে পেরেছি, আর একটা দেখতে পারবোনা এমনতো হবার নয়। দেখা শেষ,সন্ধ্যাও আঁধার নিয়ে নামল। সে দিন আর কুটুম আনা হয়নি, বাড়ি ফিরে মিথ্যা বলেছিলাম কুটুম আসতে চান না।
  
    বৈশাখ মাস জুড়ে ছিল ফসলের উৎসব, মানুষের উৎসব। চারদিকে সোনালী ধান কাটার ধুম পড়ে যেত, সবাই ব্যস্ত থাকত ধান নিয়ে। বাড়ি ভরে যেত ফসলে, ঘ্রাণে, মানুষে।


   এমন আরো অনেক স্মৃতি আছে যা ভুলে গেছি বা ভুলেই যাচ্ছি,  আর এগুলো শুধুই সুন্দর স্মৃতিই নয়, গ্রাম বাংলা, বাঙ্গালীর সংস্কৃতিও। আমরা আমাদের ভুলে অনেক দূরেই যাচ্ছি, বিদেশী সংস্কৃতিকে অনুমোদন দিয়ে ভাবছি আমাদের সংস্কৃতি সম্মৃদ্ধ হচ্ছে। অথচ এটাই সত্য যে সংস্কৃতিই হলো একটা জাতির একমাত্র নিজস্বতা যা অন্যদের থেকে আলাদা করে চেনায়।






ওল্ডহাম, ম্যানচেস্টার /২০১৫